‘রেন্টাল ফাঁদে’ অনিশ্চিত যাত্রায় সরকার
বিতর্ক ও বড় লোকসানের মধ্যেই বেসরকারি খাতের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়ে এগিয়ে চলেছে সরকার।
শুরুতে তিন থেকে পাঁচ বছরের অনুমতি পেলেও ইতোমধ্যে ১০টির চুক্তির মেয়াদ আরো ৩ থেকে ৫ বছর বাড়ানো হয়েছে। যদিও এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে গত চার বছরে সরকারকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর ব্যয়ের তিন চতুর্থাংশ মিটিয়ে ফেলা যায়।
দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা এখন প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট। আর মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ আসছে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে। কিন্তু সেজন্য যে টাকা লাগছে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট খরচের প্রায় অর্ধেক।
এই পরিস্থিতি কতোদিন চলবে সে সম্পর্কেও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কিছু বলা হচ্ছে না।
ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “থিওরিটিক্যালি আমরা যদি তাদের কাছ থেকে মূলধনী মূল্য (ক্যাপিটাল কস্ট) কমিয়ে সস্তায় বিদ্যুৎ কিনতে পারি, তাহলে আবার নতুন কেন্দ্রের কন্ট্রাক্ট দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ আনার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কিছু কেন্দ্র করার কথা রয়েছে। আর ‘রেন্টালগুলোতো’ আছেই।
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে গঠিত সরকারি কমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদনে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসব কেন্দ্র চালিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য মনে করেন, ২০১৮-১৯ সালের পর ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র রাখার কোনো কারণ নেই। ওই সময় আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কথা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাবে ভাড়া বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার পর গত চার অর্থবছরে তাদের লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা, যা মেটাতে হয়েছে ভর্তুকিতে। উচ্চমূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে গত পাঁচ বছরে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে সাত বার।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব মিলিয়ে ভয়াবহ নাজুক অবস্থা। একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি। তারপরও বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না।”
তিনি মনে করেন, তেলের ওপর নির্ভরতা বাড়ালে দাম আরো বাড়বে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্য দিতে হবে নাগরিকদের।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বেড়ে সম্প্রতি ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। আর এই বিদ্যুতের ৭০ শতাংশের বেশি আসে গ্যাস থেকে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে এই পরিমাণ আর বাড়ানোর উপায় নেই।
বর্তমানে মোট বিদ্যুতের ৩ শতাংশেরও কম আসছে কয়লা থেকে। এর ব্যবহার বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা ৩৪ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার কথা সরকারের মহাপরিকল্পনায় বলা হলেও কয়লা উত্তোলন নিয়েই সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ১৩টি বিদ্যুত কেন্দ্রের অনুমতি দেয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দfয়িত্ব নেওয়ার পর অনুমতি পায় আরো ২০টি কেন্দ্র।
কিন্তু স্বল্প সময়ে চালু করতে গিয়ে একদিকে মূলধনী ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে বেশিরভাগ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহারের কারণে বিদ্যুতের দামও পড়ছে কয়েকগুণ বেশি।
পিডিবির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত চার অর্থবছরে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পিডিবি কিনেছে মোট বিদ্যুতের প্রায় ২০ শতাংশ। আর এজন্য খরচ হয়েছে বিদ্যুৎ কেনার মোট ব্যয়ের ৪২ শতাংশ।
গত চার অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্র থেকে পিডিবির কেনা প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের গড় মূল্য পড়েছে ৪ টাকা ৫২ পয়সা। এর মধ্যে ভাড়ার কেন্দ্রগুলোরথেকে কিনতে গড়ে খরচ হয়েছে ৯ টাকা ৫০ পয়সা।
ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের কারণেই যে ভর্তুকি বেড়েছে তা স্বীকার করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে থাকা ম. তামিম। ওই সময়ই এ ধরনের কেন্দ্রের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তামিম বলেন, ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র চালুর আগে পিডিবির ভর্তুকি কখনো এক হাজার কোটি টাকার ওপরে যায়নি।
“গত চার বছরে যে টাকা বিদ্যুতের ভর্তুকিতে গেছে, তা দিয়ে পদ্মা সেতু প্রায় করে ফেলা যায়। তবে দেখার বিষয় কোনটা থেকে জিডিপিতে সংযোজন বেশি হবে। অবশ্য বিদ্যুতের ভর্তুকির রিটার্ন আরো বেশি হওয়া উচিৎ ছিল।”
বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯১ কোটি ডলার, যা নিজস্ব অর্থায়নে মেটানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার।
এর আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর জন্য জিপিডিতে দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হয়েছে।
ভর্তুকির পক্ষে যুক্তি দিয়ে তৌফিক-ই ইলাহী বলেন, “আমি বলি এটা সোশ্যাল কস্ট। বিদ্যুতের সুযোগ সুবিধা তো মানুষের কাছেই যাচ্ছে, শিল্পের উপকার হচ্ছে।
“বিদ্যুতের দাম নির্ভর করে জ্বালানির ওপর। আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস প্রয়োজন, বর্তমানের ফিল্ডগুলো থেকে সে পরিমাণ সাপ্লাই বাড়ানো সম্ভব না। রেন্টাল না করে আমরা যদি ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক লংটার্ম কন্ট্রাক্টও নিতাম, তাহলেও বিদ্যুতের দামটা বেশি হতো।”
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ২০৩০ সালকে মাথায় রেখে করা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য চুক্তি হয়েছে। আর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।
“এটা করতে সময় ও টাকা লাগে। কয়লা আনা ও মজুদ করা লাগে এবং অনেক জমি লাগে। আবার নিজেদের কয়লা দিয়ে করতে গেলেও সাত আট বছর লাগবে। সেইজন্য আমরা রেন্টালের সময় বাড়ালাম।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম. তামিম অবশ্য মনে করেন, গত সরকার স্বল্প মেয়াদে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কাজ করলেও মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হিসাবে কিছু করেনি।
“কয়লা নিয়ে সরকারের নীতিতেও ভুল আছে। দেশি কয়লায় এখনো হাত দিচ্ছে না। কয়লা আমদানির বিষয়ও স্পষ্ট না।”
গত মেয়াদের শেষ বছরে এসে রূপপুরে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে সরকার, যাতে ব্যয় হবে তিন থেকে চারশ কোটি ডলার।
এছাড়া ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমদানিনির্ভর কয়লায় চলবে এমন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিও স্থাপন করা হয়েছে বাগেরহাটের রামপালে।
বেসরকারি খাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতিও গত বছরই দেয়া হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, “খরচ কমাতে হলে তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতেই হবে। কয়লা তুলে বা আমদানি করে- যেভাবেই হোক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু এসবই কথার কথা থেকে যাচ্ছে, কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না।”
আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে ৪ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৫৮টি বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হয়েছে। আর ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে ৫০০ মেগাওয়াট। ৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার আরো ৩১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন।
বিতর্ক ও বড় লোকসানের মধ্যেই বেসরকারি খাতের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়ে এগিয়ে চলেছে সরকার।
শুরুতে তিন থেকে পাঁচ বছরের অনুমতি পেলেও ইতোমধ্যে ১০টির চুক্তির মেয়াদ আরো ৩ থেকে ৫ বছর বাড়ানো হয়েছে। যদিও এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে গত চার বছরে সরকারকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর ব্যয়ের তিন চতুর্থাংশ মিটিয়ে ফেলা যায়।
দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা এখন প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট। আর মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ আসছে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে। কিন্তু সেজন্য যে টাকা লাগছে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট খরচের প্রায় অর্ধেক।
এই পরিস্থিতি কতোদিন চলবে সে সম্পর্কেও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কিছু বলা হচ্ছে না।
ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “থিওরিটিক্যালি আমরা যদি তাদের কাছ থেকে মূলধনী মূল্য (ক্যাপিটাল কস্ট) কমিয়ে সস্তায় বিদ্যুৎ কিনতে পারি, তাহলে আবার নতুন কেন্দ্রের কন্ট্রাক্ট দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ আনার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কিছু কেন্দ্র করার কথা রয়েছে। আর ‘রেন্টালগুলোতো’ আছেই।
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে গঠিত সরকারি কমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদনে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসব কেন্দ্র চালিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য মনে করেন, ২০১৮-১৯ সালের পর ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র রাখার কোনো কারণ নেই। ওই সময় আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কথা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাবে ভাড়া বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার পর গত চার অর্থবছরে তাদের লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা, যা মেটাতে হয়েছে ভর্তুকিতে। উচ্চমূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে গত পাঁচ বছরে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে সাত বার।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব মিলিয়ে ভয়াবহ নাজুক অবস্থা। একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি। তারপরও বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না।”
তিনি মনে করেন, তেলের ওপর নির্ভরতা বাড়ালে দাম আরো বাড়বে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্য দিতে হবে নাগরিকদের।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বেড়ে সম্প্রতি ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। আর এই বিদ্যুতের ৭০ শতাংশের বেশি আসে গ্যাস থেকে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে এই পরিমাণ আর বাড়ানোর উপায় নেই।
বর্তমানে মোট বিদ্যুতের ৩ শতাংশেরও কম আসছে কয়লা থেকে। এর ব্যবহার বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা ৩৪ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার কথা সরকারের মহাপরিকল্পনায় বলা হলেও কয়লা উত্তোলন নিয়েই সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ১৩টি বিদ্যুত কেন্দ্রের অনুমতি দেয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দfয়িত্ব নেওয়ার পর অনুমতি পায় আরো ২০টি কেন্দ্র।
কিন্তু স্বল্প সময়ে চালু করতে গিয়ে একদিকে মূলধনী ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে বেশিরভাগ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহারের কারণে বিদ্যুতের দামও পড়ছে কয়েকগুণ বেশি।
পিডিবির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত চার অর্থবছরে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পিডিবি কিনেছে মোট বিদ্যুতের প্রায় ২০ শতাংশ। আর এজন্য খরচ হয়েছে বিদ্যুৎ কেনার মোট ব্যয়ের ৪২ শতাংশ।
গত চার অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্র থেকে পিডিবির কেনা প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের গড় মূল্য পড়েছে ৪ টাকা ৫২ পয়সা। এর মধ্যে ভাড়ার কেন্দ্রগুলোরথেকে কিনতে গড়ে খরচ হয়েছে ৯ টাকা ৫০ পয়সা।
ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের কারণেই যে ভর্তুকি বেড়েছে তা স্বীকার করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে থাকা ম. তামিম। ওই সময়ই এ ধরনের কেন্দ্রের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তামিম বলেন, ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র চালুর আগে পিডিবির ভর্তুকি কখনো এক হাজার কোটি টাকার ওপরে যায়নি।
“গত চার বছরে যে টাকা বিদ্যুতের ভর্তুকিতে গেছে, তা দিয়ে পদ্মা সেতু প্রায় করে ফেলা যায়। তবে দেখার বিষয় কোনটা থেকে জিডিপিতে সংযোজন বেশি হবে। অবশ্য বিদ্যুতের ভর্তুকির রিটার্ন আরো বেশি হওয়া উচিৎ ছিল।”
বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯১ কোটি ডলার, যা নিজস্ব অর্থায়নে মেটানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার।
এর আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর জন্য জিপিডিতে দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হয়েছে।
ভর্তুকির পক্ষে যুক্তি দিয়ে তৌফিক-ই ইলাহী বলেন, “আমি বলি এটা সোশ্যাল কস্ট। বিদ্যুতের সুযোগ সুবিধা তো মানুষের কাছেই যাচ্ছে, শিল্পের উপকার হচ্ছে।
“বিদ্যুতের দাম নির্ভর করে জ্বালানির ওপর। আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস প্রয়োজন, বর্তমানের ফিল্ডগুলো থেকে সে পরিমাণ সাপ্লাই বাড়ানো সম্ভব না। রেন্টাল না করে আমরা যদি ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক লংটার্ম কন্ট্রাক্টও নিতাম, তাহলেও বিদ্যুতের দামটা বেশি হতো।”
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ২০৩০ সালকে মাথায় রেখে করা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য চুক্তি হয়েছে। আর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।
“এটা করতে সময় ও টাকা লাগে। কয়লা আনা ও মজুদ করা লাগে এবং অনেক জমি লাগে। আবার নিজেদের কয়লা দিয়ে করতে গেলেও সাত আট বছর লাগবে। সেইজন্য আমরা রেন্টালের সময় বাড়ালাম।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম. তামিম অবশ্য মনে করেন, গত সরকার স্বল্প মেয়াদে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কাজ করলেও মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হিসাবে কিছু করেনি।
“কয়লা নিয়ে সরকারের নীতিতেও ভুল আছে। দেশি কয়লায় এখনো হাত দিচ্ছে না। কয়লা আমদানির বিষয়ও স্পষ্ট না।”
গত মেয়াদের শেষ বছরে এসে রূপপুরে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে সরকার, যাতে ব্যয় হবে তিন থেকে চারশ কোটি ডলার।
এছাড়া ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমদানিনির্ভর কয়লায় চলবে এমন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিও স্থাপন করা হয়েছে বাগেরহাটের রামপালে।
বেসরকারি খাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতিও গত বছরই দেয়া হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, “খরচ কমাতে হলে তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতেই হবে। কয়লা তুলে বা আমদানি করে- যেভাবেই হোক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু এসবই কথার কথা থেকে যাচ্ছে, কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না।”
আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে ৪ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৫৮টি বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হয়েছে। আর ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে ৫০০ মেগাওয়াট। ৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার আরো ৩১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন।
Post a Comment