বিদেশীরাও চাইছেন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন
কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু
জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ রাজনীতির নামে সহিংসতা বন্ধের আহ্বানের পাশাপশি হরতাল দিয়ে মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় অব্যাহতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে আন্তর্জাতিক মহল। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে দৌড়ঝাঁপ চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কূটনীতিকরা। একই সঙ্গে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিয়ে আসছে জাতিসংঘসহ বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রগুলো। তাদের দৌড়ঝাঁপ ও কথাবার্তা থেকে বেরিয়ে আসছে সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে নির্বাচন হোক। বিরোধী দলকে এমনটাও আশ্বস্ত করতে চাইছে যে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হলে তারাই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা দেখভাল করবেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠানের পক্ষে অনড় অবস্থানে আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। অপরদিকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে রাজপথ সহিংস করে তুলেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। এ দুটি বড় জোটের অনড় অবস্থানের কারণে সকল দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মাঠে নেমেছে বিশ্বমাতব্বর রাষ্ট্রখ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত। আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘও নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে জোট দুটিকে নির্বাচনে আনার জন্য। প্রধান বিরোধী দল দাবি আদায়ে সহিংসতার পথ বেছে নিলেও আন্তর্জাতিক মহল বলছে ভিন্ন কথা। বার বার তাঁরা সংহিসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আলোচনার মাধ্যমে চলমান সমস্যার সমাধান করার তাগিদ দিয়ে আসছেন।
নির্বাচন সামনে রেখে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সংলাপ অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিলেন আরও আগে। তাছাড়া জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো সংস্থাটির মহাসচিবের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছেন। তবে বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বেশি দৌড়ঝাঁপ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনা। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরই মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই তিনি। হঠাৎ ভারত সফরও করে এসেছেন তিনি। অবশ্য তার সাম্প্রতিক ভারত সফরকে কূটনৈতিক সম্পর্কে শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য করে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচানও করা হচ্ছে।
বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্র রয়েছেন। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী গত মাসের ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখে হরতালের ডাক দেয়ার পর ২৬ তারিখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ফোন করে সংলাপে আহ্বান জানিয়ে গণভবনে আমন্ত্রণ জাননোর বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মহল ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদী হয়েও উঠেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া না দেয়ার বিষয়টি ভালভাবে নেয়নি কূটনৈতিক মহল। হরতাল চলা অবস্থায় মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় কানাডা ও চীনের রাষ্ট্রদূত বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য দুই দলের শীর্ষ ব্যক্তিকে পরামর্শ দেন।
এর আগে এই দুটি দেশ থেকে একই ধরনের আহ্বান ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গেল সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কূটনীতিকরা সংহিসতার মাধ্যমে প্রতিবাদ না করার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আবারও দুই নেত্রীকে আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চত করার পরামর্শ দেন তাঁরা। ওই সভায় দীপু মনিও কূটনীতিকদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলার আহ্বান জানান। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও এমন কয়েকটি বৈঠকের খবর পাওয়া গেছে। এদিন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন মজেনা। সন্ধ্যায় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানোর উদ্দেশে নিজ দেশের উদ্দেশে উড়াল দেয়ার আগে গুলশানে নিজের বাসায় সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এ বৈঠক হয়। একই দিন বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শমসের মোবিন চৌধুরীর সঙ্গেও নিজের বাসায় বৈঠক করেন কানাডীয় হাই কমিশনার হিদার ক্রুডেন। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে তাঁর পার্ক রোডের বাসভবনে দুপুর ২টা থেকে সোয়া ৩টা পর্যন্ত বৈঠক করেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন।
এছাড়া সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বৈঠক হয় ব্রিটেনের ডেপুুটি হাইকমিশনার রবার্ট ডব্লিউ গিবসনের। একই দিন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। এর প্রেক্ষিতে তিনি সকলকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণভাবে নিজের মত প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন। দুই নেত্রীর মধ্যে সাম্প্রতিক সংলাপের সম্ভাবনায় বান কি মুন আশাবাদী উল্লেখ করে তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে এর জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানান।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে তিন দিনের হরতালে সহিংসতায় ১৫ জনেরও বেশি নিহত ও পুলিশসহ বহু সংখ্যক মানুষ আহত হওয়ার পর দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব এই উদ্বেগের কথা জানালেন। এর আগে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রও দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীতে পুলিশের সঙ্গে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের একাধিক সংঘর্ষে কিছুসংখ্যক মানুষ নিহত ও বহু আহত হওয়ার প্রেক্ষিতে রাজনীতি বিষয়ক জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। সে সময় তিনি অবাধ, স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য ও সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি গঠনমূলক পরিবেশ তৈরিতে সকলকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
Post a Comment