আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীনের ফাঁসি
তালেব রানা
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল রবিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করে।
রায়ে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিককে হত্যার মোট ১১টি অভিযোগ আসামিদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব অপরাধে একক দণ্ড হিসেবে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। রায়ে বলা হয়, এ দু'জন মানবতা ও মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে যে মাত্রার অপরাধ করেছে তাতে সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ না দিলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৈনিক ইত্তেফাকের তত্কালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, আবুল খায়ের, ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, চিকিত্সক মো. মর্তুজা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক মো. ফজলে রাব্বী এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করা হয়। আর এ ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন জামায়াতের তত্কালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আল বদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। আর ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আল বদর বাহিনীর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন এর প্রধান বাস্তবায়নকারী। বর্তমানে পলাতক আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে আর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে আছেন।
এদিকে, রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করলেও ন্যায় বিচার না পাওয়ার দাবি করেছে আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে নিযুক্ত আইনজীবীরা। অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল ও ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের প্রধান সমন্বয়কারী এম কে রহমান বলেন, জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা অনুযায়ী এই দুইজন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো। তারা আত্মসমর্পণ করলে বা গ্রেফতার হলে আইন অনুযায়ী রায় কার্যকর হবে। রাষ্ট্র আইন অনুযায়ী তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেবে।
মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, গত ৪২ বছর ধরে জাতি বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার চেয়ে আসছিলো। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। অন্যদিকে, আশরাফুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান বলেন, এ রায় প্রত্যাশিত হয়নি। তারা দেশে নেই। তারা এসে যদি আপিল করেন আশা করি তারা বেকসুর খালাস পাবেন। এদিকে, রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের স্বজনরা।
গতকাল মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালসহ সুপ্রিম কোর্টের আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থান সংকুলান না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর এজলাস কক্ষে রায় ঘোষণা করা হয়। সারাংশ রায়ের প্রথম অংশ পড়েন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া। চূড়ান্ত অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। দুপুর পৌনে ১টার দিকে সারাংশ পড়া শেষ হয়।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত নয়টি মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
রায়ে যা বলা হলো:
আল বদর বাহিনী ছিলো জামায়াতের ডেথ স্কোয়াড। যারা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলো। লরেন্স লিফসুলজ-এর 'বাংলাদেশ: আনফিনিশড রেভোল্যুশন' বইতে আল বদরের বিষয়ে বলা হয়েছে, আল বদর কিছু জঘন্য হত্যাকাণ্ড বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য মূল দায়ী। আল বদরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের কথাও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
রায়ে আরো বলা হয়, অভিযুক্ত মুঈনুদ্দীন ছিলেন আল বদরের অপারেশন ইনচার্জ আর আশরাফুজ্জামান ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। সকল সাক্ষ্য ও নথিপত্রের মাধ্যমে তাদের দুই জনের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, আল বদরের নেতা হিসেবে আসামিদের শীর্ষ অবস্থান, অপরাধে অংশগ্রহণের ভূমিকা, হত্যাকাণ্ডের ধরন ও প্রকৃতি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে আসামিরা পূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন। এসব দিক বিবেচনায় তাদের উপর সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির দায়ও বর্তায়। তাদের শাস্তি হিসেবে জাতি শুধু মৃত্যুদণ্ডই আশা করে। তাই মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হচ্ছে।
জাতির জন্য লজ্জার!
রায়ে বলা হয়, ফেনী জেলার পুলিশের বিশেষ শাখার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের আমলে দুবার মুঈনুদ্দীন তার গ্রামের বাড়িতে এসেছিলো। রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষী বলেছেন, পুলিশের পাহারায় ঐ দুবার মুঈনুদ্দীন এসেছিলেন। তাকে বিচারের মুখোমুখি না করে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে। মুঈনুদ্দীনের মতো অপরাধীকে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়ার ঘটনা জাতির জন্য লজ্জাকর।
সেলিনা পারভীনের প্রতি সদয় হয়নি খুনিরা:
রায়ে বলা হয়, সেলিনা পারভীন তার জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার একটি শিশু সন্তান আছে। তাকে দেখার কেউ নেই। কিন্তু খুনি আল বদর সদস্যরা তার প্রতি সদয় হয়নি। ২২ নম্বর সাক্ষীর ভাষ্য অনুযায়ী, তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
পলাতক মুঈনুদ্দীন-আশরাফ
ফেনীর দাগনভূঞা থানার চানপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে জন্ম চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের। একাত্তরে মুঈনুদ্দীন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসাবেও তিনি কাজ করেছেন। যুদ্ধের শেষভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন।
১৯৪৮ সালে গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে আশরাফুজ্জামান খানের জন্ম। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আশরাফুজ্জামান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভাগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান তিনি। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল বাস্তবায়নকারী নেতা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করেন। পরে সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে আশরাফুজ্জামান খানের ঠিকানা নিউইয়র্কের জ্যামাইকা।
মামলার বিচারিক কার্যক্রম:
চলতি বছরের ২৫ জুন মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ১৫ জুলাই। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিপক্ষে কোনো সাক্ষী না থাকায় ২৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।
আইনজীবী ছিলেন যারা:
রাষ্ট্রপক্ষে মুঈনুদ্দিন-আশরাফের মামলা পরিচালনা করেন অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, সাহিদুর রহমান, তুরিন আফরোজ, নুরজাহান মুক্তা, সাবিনা ইয়াসমিন খান। অন্যদিকে আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।
তালেব রানা
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল রবিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করে।
রায়ে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিককে হত্যার মোট ১১টি অভিযোগ আসামিদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব অপরাধে একক দণ্ড হিসেবে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। রায়ে বলা হয়, এ দু'জন মানবতা ও মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে যে মাত্রার অপরাধ করেছে তাতে সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ না দিলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৈনিক ইত্তেফাকের তত্কালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, আবুল খায়ের, ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, চিকিত্সক মো. মর্তুজা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক মো. ফজলে রাব্বী এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করা হয়। আর এ ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন জামায়াতের তত্কালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আল বদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। আর ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আল বদর বাহিনীর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন এর প্রধান বাস্তবায়নকারী। বর্তমানে পলাতক আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে আর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে আছেন।
এদিকে, রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করলেও ন্যায় বিচার না পাওয়ার দাবি করেছে আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে নিযুক্ত আইনজীবীরা। অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল ও ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের প্রধান সমন্বয়কারী এম কে রহমান বলেন, জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা অনুযায়ী এই দুইজন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো। তারা আত্মসমর্পণ করলে বা গ্রেফতার হলে আইন অনুযায়ী রায় কার্যকর হবে। রাষ্ট্র আইন অনুযায়ী তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেবে।
মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, গত ৪২ বছর ধরে জাতি বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার চেয়ে আসছিলো। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। অন্যদিকে, আশরাফুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান বলেন, এ রায় প্রত্যাশিত হয়নি। তারা দেশে নেই। তারা এসে যদি আপিল করেন আশা করি তারা বেকসুর খালাস পাবেন। এদিকে, রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের স্বজনরা।
গতকাল মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালসহ সুপ্রিম কোর্টের আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থান সংকুলান না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর এজলাস কক্ষে রায় ঘোষণা করা হয়। সারাংশ রায়ের প্রথম অংশ পড়েন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া। চূড়ান্ত অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। দুপুর পৌনে ১টার দিকে সারাংশ পড়া শেষ হয়।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত নয়টি মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
রায়ে যা বলা হলো:
আল বদর বাহিনী ছিলো জামায়াতের ডেথ স্কোয়াড। যারা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলো। লরেন্স লিফসুলজ-এর 'বাংলাদেশ: আনফিনিশড রেভোল্যুশন' বইতে আল বদরের বিষয়ে বলা হয়েছে, আল বদর কিছু জঘন্য হত্যাকাণ্ড বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য মূল দায়ী। আল বদরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের কথাও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
রায়ে আরো বলা হয়, অভিযুক্ত মুঈনুদ্দীন ছিলেন আল বদরের অপারেশন ইনচার্জ আর আশরাফুজ্জামান ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। সকল সাক্ষ্য ও নথিপত্রের মাধ্যমে তাদের দুই জনের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, আল বদরের নেতা হিসেবে আসামিদের শীর্ষ অবস্থান, অপরাধে অংশগ্রহণের ভূমিকা, হত্যাকাণ্ডের ধরন ও প্রকৃতি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে আসামিরা পূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন। এসব দিক বিবেচনায় তাদের উপর সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির দায়ও বর্তায়। তাদের শাস্তি হিসেবে জাতি শুধু মৃত্যুদণ্ডই আশা করে। তাই মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হচ্ছে।
জাতির জন্য লজ্জার!
রায়ে বলা হয়, ফেনী জেলার পুলিশের বিশেষ শাখার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের আমলে দুবার মুঈনুদ্দীন তার গ্রামের বাড়িতে এসেছিলো। রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষী বলেছেন, পুলিশের পাহারায় ঐ দুবার মুঈনুদ্দীন এসেছিলেন। তাকে বিচারের মুখোমুখি না করে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে। মুঈনুদ্দীনের মতো অপরাধীকে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়ার ঘটনা জাতির জন্য লজ্জাকর।
সেলিনা পারভীনের প্রতি সদয় হয়নি খুনিরা:
রায়ে বলা হয়, সেলিনা পারভীন তার জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার একটি শিশু সন্তান আছে। তাকে দেখার কেউ নেই। কিন্তু খুনি আল বদর সদস্যরা তার প্রতি সদয় হয়নি। ২২ নম্বর সাক্ষীর ভাষ্য অনুযায়ী, তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
পলাতক মুঈনুদ্দীন-আশরাফ
ফেনীর দাগনভূঞা থানার চানপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে জন্ম চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের। একাত্তরে মুঈনুদ্দীন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসাবেও তিনি কাজ করেছেন। যুদ্ধের শেষভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন।
১৯৪৮ সালে গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে আশরাফুজ্জামান খানের জন্ম। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আশরাফুজ্জামান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভাগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান তিনি। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল বাস্তবায়নকারী নেতা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করেন। পরে সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে আশরাফুজ্জামান খানের ঠিকানা নিউইয়র্কের জ্যামাইকা।
মামলার বিচারিক কার্যক্রম:
চলতি বছরের ২৫ জুন মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ১৫ জুলাই। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিপক্ষে কোনো সাক্ষী না থাকায় ২৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।
আইনজীবী ছিলেন যারা:
রাষ্ট্রপক্ষে মুঈনুদ্দিন-আশরাফের মামলা পরিচালনা করেন অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, সাহিদুর রহমান, তুরিন আফরোজ, নুরজাহান মুক্তা, সাবিনা ইয়াসমিন খান। অন্যদিকে আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।
Post a Comment