স্রোতস্বিনী, প্রমত্তা, খরস্রোতা, জলরাশি— এ রকম বেশ কিছু শব্দ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কথায় বা লেখনীতে শব্দের ব্যবহার না থাকলে জীবনে সেই শব্দগুলোর কোনো আক্ষরিক প্রভাব থাকে না। শব্দগুলো অভিধান থেকে হয়তো মুছে যাবে না, তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ জলাভূমি বা জলাধার চলনবিল। ছোট-বড় অনেকগুলো নদী, অসংখ্য খাল এবং আরও বেশ কিছু বিল পরস্পর সংযুক্ত হয়ে একটি বৃহত্ জলরাশির নাম চলনবিল।
বর্ষা এলে চলনবিল হয়ে ওঠে সুবিশাল খরস্রোতা। যার কূলের দেখা মেলা ভার, শুধু পানি আর পানি, সাগরের মতো বিশাল বিশাল ঢেউ মানুষের জীবন প্রণালি এখানে জল আর নৌকা দিয়ে বাঁধা। একসময় ব্যাপক মত্স্য সম্পদ ছিল চলনবিলে, ছিল বিশাল জেলেগোষ্ঠী। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর চলনবিলে ছিল জলের জৌলুস নিয়মিত পানি প্রবাহের ফলে বিলের পানি স্থির না হয়ে ছিল বহমান তাই এ বিলের নাম হয় চলনবিল।
বাংলাদেশের তিনটি জেলা রাজশাহী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জুড়ে বিস্তৃৃত রয়েছে চলনবিল। বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, চলনবিলের অবস্থান নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা ও গুমানী নদীর উত্তর পাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ ও পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলা দুটির অধিকাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে চলনবিল।
সময়ভেদে এ বিলের আয়তন বাড়ে ও কমে বর্ষায় চলনবিল আয়তনে প্রায় ৩৭৫ বর্গকিলোমিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে কমে দাঁড়ায় ৫২-৭৮ বর্গকিলোমিটারে সৃষ্টি হওয়ার সময় এর আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহপথ পরিবর্তনের সময় চলনবিলের সৃষ্টি হয় বলে জানা যায় আজকের যমুনা নদীই ব্রহ্মপুত্র নদের পরিবর্তিত রূপ নদী চলবে তার আপন গতিতেই, প্রকৃতির নিয়মেই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হবে তার রূপ।
নদী একদিকে ভাঙবে, অন্যদিকে গড়বে— কথাগুলো সবারই জানা তারপরও বলছি, কারণ, সবকিছু জানা-বোঝার পরও আমরা আমাদেরই স্বার্থে নদী, খাল-বিল শাসনের নামে প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে তার স্বাভাবিক গতিপথ রোধ করে নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নদীর ওপর রাস্তা-ঘাট, বাঁধ, ব্যারাজ, সেতু, কালভার্ট, ক্রস ড্যাম, স্লুইস গেটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করেছি এসব কর্মকাণ্ড চলনবিলের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পরিবেশ ও জনজীবনেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে।
একসময় এর পানি ধারণক্ষমতা, প্রাকৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্য, খাল-বিল, নদী-নালার আন্তঃসম্পর্ক প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছিল বিলের পানি ছিল বহমান; সংযুক্ত নদ-নদী ও অন্যান্য খাল-বিলগুলোতেও ছিল পানির প্রবাহ কালক্রমে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে, প্রভাবশালীদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থতায় এখানে বাস্তবায়িত হয়েছে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ শোনা যায়, বিল অঞ্চলে ২১টি নদী ও ৯৩টি ছোট-বড় বিল ছিল ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত চলনবিল থেকে আশ-পাশের সব অঞ্চলে নৌকায় যাতায়াত সহজ ছিল।
১৯৭৬-এর পর থেকে এখানকার প্রাকৃতিক অবস্থাকে ধ্বংস করার কাজ শুরু হয় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে। ফলে নৌপথে যাতায়াতের সুবিধা কমতে থাকে এবং ১৯৯০-এর দিকে চলনবিলকে প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস ও বিপর্যস্ত করে ফেলা হয় উল্লেখ্য, চলনবিল ও সংলগ্ন সব খাল-বিলের পানি সরবরাহের প্রধান উত্স বড়াল নদ।
পদ্মা নদী থেকে উত্পন্ন হয়ে চলনবিল দিয়ে প্রবাহিত বড়াল গিয়ে মিশেছে আরেকটি অন্যতম প্রধান নদী যমুনায়। ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদ বড়ালের উত্সমুখ রাজশাহীর চারঘাটে ১৯৮৫ সালে নির্মিত স্লুইস গেটের মাধ্যমে এটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পরে এর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় আটঘরিয়া নামক স্থানে বড়ালের ওপর আরেকটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট রেগুলেটর স্থাপন করায় এরপর শুরু হলো মৃত নদীর বুক চিরে রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর এমনকি সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ। বন্ধ হলো বড়ালের পানিপ্রবাহ, শুকিয়ে গেল এর শাখা নদ মুসা খাঁ ও নন্দকূজা। অন্যদিকে, মুসা খাঁ থেকে পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় মরে গেল হোজা নদী; নারদের প্রাণও ওষ্ঠাগত চলনবিলের ওপরেও এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিল হারিয়ে গেল জলাভূমি, মত্স্য ও জলজ সম্পদের ভাণ্ডার। জনজীবন হলো বিপর্যস্ত।
বিশ্বের বড় বড় দেশ যখন বাঁধের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বাঁধ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তে উপনীত, তখন আমাদেরও বসে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও প্রাণবৈচিত্র্য এই নদীগুলোর প্রাণপ্রবাহ ফিরিয়ে দিতে আমাদেরও উদ্যোগী হতে হবে সঠিক ও পরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে নদী ধ্বংসযজ্ঞ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অথবা বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য নদীর গতিপথ আটকে বাঁধ নির্মাণের এই সংস্কৃতির বলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য স্বাদু পানির আধার ও ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। তাই কৃষি অর্থনীতির ভীত আরও পোক্ত করতে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।
লিপিকার : সানজিদা খান রিপা
Post a Comment